মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:৪৫ পূর্বাহ্ন

আপনজনের মুখোশে স্বার্থের খেলা

জাহাঙ্গীর আলম
  • শুক্রবার, ১১ জুলাই, ২০২৫
  • ১২৫

বর্তমান সমাজব্যবস্থায় এক গভীর মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে—মানবসম্পর্কে স্বার্থপরতার শিকড় যেন দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। কেউ কারও আপন নয়, সবাই নিজের প্রয়োজন, স্বার্থ আর সুবিধার দিকে দৃষ্টি রাখে। “আপন বলে কেউ নাই”—এমন কথাগুলো শুধু হতাশা নয়, একটি বড় সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলনও বটে।

আপন বলে কেউ নাই”—এই বাক্যটি একসময়ে হতাশাগ্রস্ত কিছু মানুষের মুখের বুলি ছিল। আজ তা যেন ক্রমেই বাস্তবতায় পরিণত হচ্ছে। সমাজে মানুষের সম্পর্কগুলো দিন দিন হয়ে পড়ছে কার্যকেন্দ্রিক, লাভ-লোকসান নির্ভর। আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব, এমনকি পরিবারেও ভালোবাসা-স্নেহ-সহানুভূতির জায়গায় ঢুকে পড়েছে হিসাব-নিকাশ আর ব্যক্তিগত সুবিধার চিন্তা।

মানবিক সম্পর্কের অবমূল্যায়ন…

বন্ধু, পরিবার কিংবা সহকর্মী—সব জায়গায় এখন সম্পর্ক অনেকটাই নির্ভর করছে পারস্পরিক লাভের ওপর। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, আত্মত্যাগ কিংবা নিঃস্বার্থ সহযোগিতা যেন এখন অতীতের গল্প।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক জীবনে মানুষ নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। ফলে সম্পর্কগুলোর গভীরতা হারিয়ে যাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে কৃত্রিমতা।

মানসিক চাপ ও একাকীত্ব বাড়ছে…

এই পরিস্থিতি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। নিজেকে “একাকী” ভাবা, অবহেলিত বা ব্যবহারযোগ্য মনে করাটা এখন সাধারণ অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকের কাছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যেসব সমাজে মানুষ পরস্পরের জন্য নিঃস্বার্থভাবে দাঁড়ায় না, সেখানে হতাশা, বিষণ্নতা ও আত্মহননের প্রবণতা বেড়ে যায়।

তবুও কিছু আশা রয়ে যায়…

তবে সবাই যে স্বার্থপর, তা একেবারেই সত্য নয়। সমাজে এখনও কিছু মানুষ আছেন যারা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেন, কষ্ট ভাগ করে নেন এবং চুপিচুপি মানুষের পাশে থাকেন। তারা হয়তো সংখ্যায় কম, কিন্তু তাদের উপস্থিতি সমাজকে এখনো কিছুটা স্বস্তি দেয়।

পারিবারিক বন্ধনে ফাটল…

এক সময় পরিবার ছিল মানুষের প্রথম এবং সর্বশেষ আশ্রয়। এখন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সন্তান বড় হলে বাবা-মা অবহেলিত হয়ে পড়ছেন, আবার অভিভাবকরা নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিচ্ছেন সন্তানের ওপর। বৃদ্ধ বাবা-মাকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে, কিংবা এক শহর থেকে আরেক শহরে চলে গিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিচ্ছে অনেকেই।

বাস্তব উদাহরণ…

চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় এক বৃদ্ধা মা দুই বছর ধরে তার সন্তানের মুখ দেখতে পাননি। পুত্র সংসার, ব্যবসা ও ‘ব্যস্ততা’র অজুহাতে ফোন করেও খোঁজ নেন না। এরকম ঘটনা দেশের নানা প্রান্তেই প্রতিদিন ঘটছে, যা মানবিক অবক্ষয়ের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।

বন্ধুত্বের সংজ্ঞায় পরিবর্তন…

একসময় বন্ধু মানেই ছিল সুখে-দুঃখে পাশে থাকা একজন মানুষ। এখন অনেক ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব মানে হচ্ছে—“যখন প্রয়োজন, তখন যোগাযোগ।” সাহায্য না করতে পারলে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী নাঈম জানান, “যখন সামান্য অর্থকষ্টে ছিলাম, যাদের বন্ধু ভাবতাম, তাদের একজনও পাশে দাঁড়ায়নি। তখনই বুঝলাম, বন্ধুত্ব এখন শর্তসাপেক্ষ।”

প্রযুক্তির ছদ্মসম্পর্ক ও আত্মকেন্দ্রিকতা…

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজার ‘ফ্রেন্ড’ বা ‘ফলোয়ার’ থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে কেউ পাশে থাকেন না—এটাই এখন বাস্তবতা। ভার্চুয়াল কনেকশন মানুষকে আলাদা করে ফেলেছে বাস্তব অনুভব থেকে। মানুষ এখন বেশি সময় দিচ্ছে পর্দার সামনে, বাস্তব মানবিক বন্ধনের বাইরে। এমনকি স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন কিংবা সহকর্মীদের মধ্যেও রয়ে যাচ্ছে অবিশ্বাস, প্রতিযোগিতা ও নিরাপত্তাহীনতা।

মানসিক স্বাস্থ্য ও সমাজে নেতিবাচক প্রভাব,…

এই বিচ্ছিন্নতা এবং “কেউ কারও আপন নয়”—এই ধারণা থেকে তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ মানসিক চাপ। বিশেষ করে তরুণ সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। বিষণ্নতা, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিশ্বাসহীনতা গ্রাস করছে বহু মানুষকে।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, “আমাদের সমাজে পারস্পরিক সহানুভূতি, শ্রদ্ধাবোধ ও দায়িত্বশীলতার জায়গাগুলো দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই প্রবণতা শুধু ব্যক্তিজীবন নয়, বৃহৎ সমাজ কাঠামোকেও ভাঙন পথে নিয়ে যাচ্ছে।”
সমাধান কোথায়?

বিশ্লেষকরা মনে করেন, শিক্ষা, পারিবারিক মূল্যবোধ ও সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। মানুষ যদি আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বের হয়ে “দেওয়ার আনন্দ” উপলব্ধি করতে শেখে, তবে সমাজে আবারও আপনজনের সংজ্ঞা ফিরে আসবে।

সম্ভাবনার আলো: এখনও কিছু মানুষ আছেন…

এই সব অন্ধকারের মধ্যেও কিছু নিঃস্বার্থ, ভালোবাসাপূর্ণ মানুষ এখনও সমাজে আছেন।

চট্টগ্রামের এক তরুণ চিকিৎসক, নিজের ব্যস্ততা উপেক্ষা করে প্রতি শুক্রবার ছিন্নমূল শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। আবার কেউ নিরবে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে খাবার দিয়ে আসেন, পরিচর্যা করেন নিঃসঙ্গ বৃদ্ধদের। এমন মানুষদের কারণেই সমাজ এখনো পুরোপুরি হৃদয়হীন হয়ে পড়েনি।

সমাধান ও করণীয়

সমাজে মানবিকতা ফিরিয়ে আনতে চাই—

® নৈতিক শিক্ষা: শিক্ষাব্যবস্থায় মানবিকতা, সহানুভূতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা শেখাতে হবে।

® পারিবারিক মূল্যবোধ: ছোটবেলা থেকেই পরিবারে শিশুদের ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ শেখাতে হবে।
® সামাজিক সচেতনতা: মিডিয়া, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর উচিত মানুষের মাঝে মানবিক সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরা।
® ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা: প্রত্যেকে নিজ থেকে চেষ্টা করলে, আশেপাশে মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব।

“আপন বলে কেউ নাই”—এই অনুভূতির পরিবর্তন সম্ভব, যদি আমরা নিজেরা কিছুটা নিঃস্বার্থ হই, একটু মানবিক হই, একটু সহানুভূতিশীল হই। কারণ, সম্পর্কের সৌন্দর্য শুধু নেওয়ায় নয়, দেয়ার মাঝেও এক অপার সুখ আছে।

গণমাধ্যম কর্মী, 
jahangirfa@yahoo.com
01749336285

Please Share This Post in Your Social Media

এই বিভাগের আরো খবর