
ঢাকার উত্তরা দিয়াবাড়ি এলাকায় ভয়াবহ এক বিমান দুর্ঘটনায় পাইলটসহ অন্তত ১৯ জন নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান (F‑7 BGI) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সোমবার দুপুরে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিধ্বস্ত হলে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৭০ জনের বেশি, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
কীভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?
বিমানটি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রশিক্ষণ ফ্লাইটে উড্ডয়ন করেছিল দুপুর ১টা ৬ মিনিটে। উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারায়।বিমানটি আশেপাশের আবাসিক এলাকা এড়িয়ে সর্বশেষ উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকার মাইলস্টোন স্কুল ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয়, যেখানে ক্লাস চলাকালীন ছিল শতাধিক শিক্ষার্থী।
বিমানবাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, “পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ তৌকির ইসলাম সাগর শেষ মুহূর্তে প্রাণ বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি বিমানটি জনবহুল এলাকাকে পাশ কাটিয়ে স্কুলে নিয়ে যান, যেখানে তিনি নিজেও প্রাণ হারান।”

ভয়াবহতা ও আতঙ্ক
বিমানটি ভবনের ছাদে আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ ও ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তেই পুরো ভবনে আগুন ও ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করতে থাকে। স্থানীয় বাসিন্দারাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
এক শিক্ষার্থী বলেন,“আমরা ক্লাসে ছিলাম। হঠাৎ ছাদের ওপর থেকে একটা বিশাল আওয়াজ। কাঁচ ভেঙে পড়ল, তারপর আগুন আর ধোঁয়া। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্কুলটা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো হয়ে যায়।”
হতাহতের বিবরণ
নিহত: ১৯ জন,ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ তৌকির ইসলাম সাগর (পাইলট) ১৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী,১ জন শিক্ষক,৪ জন স্কুল স্টাফ,আহত: ১৭০+ জন।গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় ৩৫ জনকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে।বাকিদের ঢামেক, ইউনাইটেড ও কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। কয়েকজন এখনো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, দুর্ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সিভিল ডিফেন্স সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেন। ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার কাজ চলে বিকেল পর্যন্ত।
প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনায় সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম দ্রুত মোতায়েন করে আহতদের চিকিৎসা ও স্থানান্তরের কাজ করে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রতিক্রিয়া ও রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন: “একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা জাতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। নিহতদের পরিবার ও আহতদের পাশে সরকার থাকবে।”
তিনি একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস ঘোষণা করেন এবং প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে সরকারি সহায়তার আশ্বাস দেন। মন্ত্রণালয়সমূহকে দ্রুত রিপোর্ট ও তদন্ত দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তদন্ত ও প্রাথমিক বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (CAAB) পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
প্রাথমিকভাবে প্রযুক্তিগত ত্রুটিই এ দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, F-7 বিমানগুলো অনেক পুরনো এবং এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে ঘাটতি রয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
দুর্ঘটনার খবরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ঘটনাটি শিরোনামে আসে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বহু আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দ শোক ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেন।
সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা যায়, স্কুল ভবনের ছাদ ধসে পড়েছে, দেয়াল কালো ধোঁয়ায় ঝলসে গেছে। ছাত্রদের রক্তাক্ত অবস্থায় বেরিয়ে আসার দৃশ্য যেন যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতা বহন করছে।
এই দুর্ঘটনা শুধু দুর্ঘটনা নয় — এটি প্রশ্ন তুলেছে শহরের আকাশসীমায় প্রশিক্ষণ ফ্লাইট, যুদ্ধবিমান পরিচালনা, এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে।
নিহতদের স্মরণে এবং ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধে এখনই প্রয়োজন নীতিগত পরিবর্তন ও উচ্চস্তরের জবাবদিহিতা।