বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:০৩ পূর্বাহ্ন

বাজেটও নেই, যন্ত্রাংশও নেই: রেলসেবা এখন জোড়াতালির ভরসায়

জাহাঙ্গীর আলম
  • সোমবার, ৪ আগস্ট, ২০২৫
  • ৩৬৭

চট্টগ্রাম রেলওয়ে বিভাগে যন্ত্রাংশ সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। ইঞ্জিনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় নিয়মিতভাবে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। যান্ত্রিক ত্রুটিতে প্রতিনিয়ত ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের শিডিউল বিপর্যয় এখন নিত্যদিনের ঘটনা। যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ার পাশাপাশি রেলসেবার ওপর আস্থা হারাচ্ছেন অনেকেই।

রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বিভাগে ১৮টি ইঞ্জিন চলন্ত অবস্থায় বিকল হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ইঞ্জিনেই ছিল ব্রেক সিস্টেম, ফ্যান বেল্ট, বিয়ারিং, কাপ্লিং, এয়ার কম্প্রেসর ও লোড মিটার সংক্রান্ত সমস্যা। এসব গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের অভাবেই ট্রেন চলাচলে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।

  • পূর্বাঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে ১১৬টি ইঞ্জিন প্রয়োজন হলেও, ১৩৫টির মধ্যে মাত্র ৭৫-৮০টি ইঞ্জিন সচল অবস্থায় রাখা সম্ভব হচ্ছে। বাকিগুলো বিকল অবস্থায় পড়ে আছে বা অস্থায়ীভাবে জোড়াতালি দিয়ে চলছে। ফলে নিয়মিত ট্রেন বিলম্ব, যাত্রী ভোগান্তি এবং ট্রেন থেমে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে।

চট্টগ্রাম বিভাগে জুন মাসে একাধিকবার ঘটেছে ওভারহিট, ওয়াটার পাইপ লিক, জেনারেটর ব্লোয়ার মোটর পুড়ে যাওয়া, কাপ্লিং ভেঙে যাওয়া এবং ব্রেক সিস্টেম বিকলের মতো ঘটনা। এসব কারণে ইঞ্জিনগুলো একাধিকবার দীর্ঘ সময় বন্ধ থেকেছে।

চাহিদা অনুযায়ী যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা যাচ্ছে না..

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. সুবক্তগীন বলেন, “চাহিদা অনুযায়ী যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে জোড়াতালি দিয়ে মেরামতের কাজ চালানো হচ্ছে। ফলে একই সমস্যা বারবার ফিরে আসছে। এর প্রভাব সরাসরি ট্রেন চলাচলে পড়ছে।”

যন্ত্রাংশ সরবরাহ বিলম্বের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিশ্ববাজার থেকে যন্ত্রাংশ আমদানির প্রক্রিয়ায় কিছু প্রশাসনিক ও সরবরাহগত জটিলতা রয়েছে। তবে আমরা আশাবাদী, খুব শিগগিরই প্রয়োজনীয় মালামাল এসে পৌঁছাবে। তখন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা যাবে এবং ট্রেন চলাচলে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে পারব।”

রেলওয়ে সূত্র জানায়, পূর্বাঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে ৪০টির বেশি ট্রেন যাতায়াত করে। এসব ট্রেনের ইঞ্জিন, ব্রেক, বগির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও সিগন্যালিং সিস্টেমে নিয়মিত মেরামতের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অনুপস্থিতিতে এসব রক্ষণাবেক্ষণ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে কখনো কখনো ট্রেন চলাচল বিলম্বিত হচ্ছে কিংবা মাঝপথে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

রেলওয়ের এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “যন্ত্রাংশের সংকট দীর্ঘদিনের সমস্যা। সাময়িকভাবে ট্রেন সচল রাখলেও, দীর্ঘমেয়াদে এটি নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হতে পারে।”

বাজেট অর্ধেকে কমেছে, এলসি হলেও যন্ত্রাংশ আসবে অক্টোবর নাগাদ রেলের সরঞ্জাম বিভাগের প্রধান মো. বেলাল সরকার জানান,“গত অর্থবছরে বরাদ্দ কম ছিল। এবার ৪০০ কোটি টাকার বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ২১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আবার ১৬০ কোটি টাকা আগের বকেয়া। বিদেশি যন্ত্রাংশের জন্য এলসি করা হয়েছে, তবে অক্টোবর নাগাদ তা হাতে আসবে বলে আশা করছি।”

তিনি আরও বলেন,“বর্তমানে শতভাগ ই-জিপি (EGP) টেন্ডার বাধ্যতামূলক হওয়ায় অযোগ্য অংশগ্রহণকারীদের কারণে রিটেন্ডার করতে হচ্ছে, এতে সময় নষ্ট হচ্ছে। জরুরি যন্ত্রাংশ কিনতে কিছু নিয়ম শিথিল করা জরুরি।”

মালামাল ক্রয় প্রক্রিয়া সহজ না হলে রেলসেবা দেওয়া কঠিন হবে: সরঞ্জাম বিভাগের প্রধান আরও বলেন, “যদি মালামাল ক্রয় প্রক্রিয়া সহজ না হয় এবং বাজেট চাহিদামতো না আসে, তাহলে সামনের দিনে রেলসেবা অব্যাহত রাখা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়বে। বর্তমান পরিস্থিতি খুবই চ্যালেঞ্জিং।”

“বর্তমানে শতভাগ ইলেকট্রনিক গভার্নমেন্ট প্রোকিউরমেন্ট (ই-জিপি) টেন্ডার বাধ্যতামূলক হওয়ায়, অনেক সময় অযোগ্য অংশগ্রহণকারীরা দরপত্রে অংশ নেয়। ফলে টেন্ডার বাতিল করে পুনরায় রিটেন্ডার করতে হয়, এতে মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। জরুরি যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম শিথিল করা এখন সময়ের দাবি।”

তিনি আরও বলেন, এই দীর্ঘমেয়াদি টেন্ডার প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি যন্ত্রাংশ সংগ্রহে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেলওয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ গণপরিবহন সেবায় ‘জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন’ অত্যন্ত জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেলওয়ের কার্যক্রমে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘাটতি, আমদানি প্রক্রিয়ায় ধীরগতি এবং বাজেট বাস্তবায়নের অক্ষমতা এই সংকটের মূল কারণ।

সাধারণ যাত্রীরাও রেলওয়ের সেবায় হতাশা প্রকাশ করেছেন। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন এমন এক যাত্রী বলেন,
“ট্রেনটা প্রায় এক ঘণ্টা দেরি করে ছাড়ল। কর্তৃপক্ষ কিছু জানায় না, শুধু বলে ‘যান্ত্রিক ত্রুটি’। নিয়মিত এমন হলে তো ভরসার জায়গা থাকে না।”

এমন পরিস্থিতিতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখার বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে।

সূত্র বলছে, একাধিক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, দরপত্র আহ্বানের পর সময়মতো মানসম্মত অংশগ্রহণ না থাকায় দরপত্র বাতিল করতে হয়েছে। আবার নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে গিয়ে অনেক সময় এক মাস বা তারও বেশি সময় লেগে যাচ্ছে, যা ট্রেন পরিচালনায় চরম ভোগান্তি তৈরি করছে।

Please Share This Post in Your Social Media

এই বিভাগের আরো খবর