
বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেওয়া ‘চব্বিশের জুলাই গণ–অভ্যুত্থান’ স্মরণে শহীদদের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে ঘোষণা ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার রেখে ঐতিহাসিক ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
গত মঙ্গলবার (৫ আগস্ট ২০২৫) বিকাল ৫টার কিছু পর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রধান রাজনৈতিক জোট ও দলের শীর্ষ নেতাদের পাশে নিয়ে এই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন তিনি। অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে সূচনা হয়, শহীদদের স্মরণে পালন করা হয় এক মিনিট নীরবতা।
জাতীয় বীরের মর্যাদা ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির ঘোষণা
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “২০২৪ সালের ৫ আগস্টে গণ–অভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এ ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হলো।”
ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়, “বাংলাদেশের জনগণ জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সকল শহীদদের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে ঘোষণা করছে এবং শহীদ পরিবার, আহত যোদ্ধা ও আন্দোলনকারী ছাত্র–জনতাকে প্রয়োজনীয় সকল আইনি সুরক্ষা প্রদান করা হবে।”
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, “এই ঐতিহাসিক দলিলটি আগামী নির্বাচনের পর গঠিত সরকার কর্তৃক গৃহীত সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে সংযোজনের ব্যবস্থা করা হবে।”
ইতিহাসের নিরিখে ২৮ দফা ঘোষণাপত্র
১০৩৬ শব্দের দীর্ঘ ২৮ দফার ঘোষণাপত্রে উঠে এসেছে পাকিস্তানি শাসনামলের ২৩ বছরের বঞ্চনা,স্বাধীনতা–পরবর্তী নানা আশাভঙ্গ, ১৯৯০ সালের গণ–অভ্যুত্থান, ২০০৭ সালের ১/১১ সেনা–সমর্থিত সরকার, এবং আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে সংঘটিত সংবিধানবিরোধী ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড।
ঘোষণাপত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, নতুন বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা, গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং মানুষের মৌলিক অধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
শহীদ পরিবারের বক্তব্যে আবেগঘন মুহূর্ত
অনুষ্ঠানের শুরুতে শহীদ পরিবারের সদস্য সাবরিনা আফরোজ সেমন্তী সূচনা বক্তব্যে বলেন, “আমার ভাই, আমার বাবা, আমার সহপাঠীরা যেদিন শহীদ হয়েছিলেন, আমরা জানতাম, তারা ফিরে আসবে না; কিন্তু আজ এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে তারা ফিরে এসেছে জাতির বুকে।”
ঐক্যবদ্ধ মঞ্চে বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ
প্রধান উপদেষ্টার পাশে দাঁড়িয়ে ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন:
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ রেজাউল করীম (চরমোনাই পীর)।
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।
গণসংহতির প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান মঞ্জু।
জাতীয় নাগরিক পার্টি–এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
জাতীয় গণফ্রন্টের টিপু বিশ্বাস।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন:
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমদ,জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, নাগরিক ঐক্যের শহীদ উল্লাহ কায়সার, জাতীয় নাগরিক পার্টির আখতার হোসেন, খেলাফত মজলিশের মহাসচিব আহমেদ আব্দুল কাদের, জেএসডির সহ-সভাপতি তানিয়া রব ও সাধারণ সম্পাদক শহীদউদ্দিন মাহমুদ স্বপন, গণফোরামের মিজানুর রহমান, বিএলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম
নতুন ইতিহাসের ভিত্তিপ্রস্তর
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এটি শুধু শহীদদের স্বীকৃতি দেয়নি, বরং নতুন বাংলাদেশ গঠনের আদর্শিক রূপরেখাও হাজির করেছে।